নির্বাচন কমিশনের (ইসি) শুনানির রায় ঘোষণার আগেই অবশেষে এমপি পদ নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনার যবনিকাপাত ঘটালেন দলীয় সব পদসহ মন্ত্রীত্ব হারানো লতিফ সিদ্দিকী। মঙ্গলবার দশম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের প্রথম কার্যদিবসে অংশ নিয়ে নিজেই পদ ছাড়ার ঘোষণা দেন তিনি। হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে কটুক্তিকারী প্রভাবশালী এই রাজনীতিবিদ সংসদে আত্মপক্ষ সমর্থন করে তার ওপর আনিত অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিজেকে আবারো নির্দোষ এবং ষড়যন্ত্রের শিকার বলে দাবি করেন।
নিজেকে সাচ্চা মুসলমান এবং পুরোপুরি আওয়ামী লীগার দাবি করে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী অপব্যাখ্যা করে সরকার থেকে তাকে দূরে সরিয়েছে। এসময় নিজের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের বর্ণনা তুলে ধরে অবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টিরও চেষ্টা চালান তিনি।
নিজের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সাবেক প্রভাবশালী নেতা লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে আমাকে হেয় করেছে। আমাকে সরকারের প্রতিপক্ষ বানাতে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি তার বক্তব্যের শুরুতেই নিজেকে বাঙ্গালী, মুসলিম ও একজন আওয়ামী লীগার দাবি করে বলেন, এই পরিচয় মুছে দেয়ার মতো শক্তি পৃথিবীর কারো নেই। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার ধর্ম কুঠরিতে আলোড়ন আন্দোলন দেখা দিয়েছে। আমি বলতে চাই, আমি ধর্মবিরোধী নই। আমি সাচ্চা মুসলমান। ধর্ম অনুরাগী। যে ফরজ একবার করার কথা বলা হয়েছে সে হজ আমি নিজেও করেছি। যারা ফরজ তরক করে সুন্নত মুস্তাহাব নিয়ে ছুটে তাদের সঙ্গে আমার ভিন্নতা রয়েছে।
তবে রাজনৈতিক জীবনে এখনো যেমন বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করছেন ভবিষ্যতেই এর ব্যতিক্রম হবে না বলে জানান লতিফ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, সবার আগে ঠিক করতে হবে রাজনৈতিক সংস্কৃতি কি হবে। বাঙালি আত্মপরিচয়ের সড়ক ঘোষণায় স্কুল ও কলেজ জীবনে চারবার বহিষ্কার হতে হয়েছে। তিনি ইসিকে দেয়া স্পীকারের চিঠি সম্পর্কেও প্রশ্ন তুলেন। তবে তিনি শেষ বেলায় কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন না বলে ঘোষণা দেন। এরপরই তিনি তার পদত্যাগের চূড়ান্ত ঘোষণা দেন। এসময় তিনি দেশবাসীর কাছে নতমস্তকে ক্ষমা চান। এরপর স্পিকারের কাছে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন।
এরআগে ২৩ আগস্ট আপিল বিভাগের রায় নিজের বিপক্ষে যাওয়ার পর নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পূর্ব নির্ধারিত শুনানিতে অংশ নিয়ে তিনি রাজনৈতিক নির্বাসনে যাওয়ার ঘোষণা দেন। তবে নিজের শির উঁচু রাখতে গিয়ে হজ ও তাবলিগ জামায়াত নিয়ে কটূক্তিকারী আওয়ামী লীগের সাবেক এই নেতা নিজেকে প্রধানমন্ত্রীর অনুগত দাবি করে তার নির্দেশেই আর বাড়াবাড়ি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানান। সেদিনও নিজেকে ধর্মবিরোধী নয়, ধর্মভীরু বলেও দাবি করে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এটি করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি। লতিফের এমন বক্তব্যের পর শুনানি স্থগিত করে দেয় ইসিও। ৬ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে ইসির সিদ্ধান্ত জানানোর কথা ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার অধিবেশন শুরুর দিনই অকস্মাৎ সংসদে এসে হাজির হন লতিফ। সারা বিকেল সহকর্মীদের সঙ্গে লবিতে সময় কাটালেও মাগরিবের নামাজের বিরতির পর অধিবেশন কক্ষে নিজের আসনে বসে অনির্ধারিত আলোচনায় অংশ নিতে স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। অনুমতি মেলার পর তিনি সবাইকে সালাম দিয়ে নিজের ওপর উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়টি তুলে ধরে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন এবং এমপি পদ থেকে ইস্তফার ঘোষণা দেন।
উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে একটি অনুষ্ঠানে লতিফ সিদ্দিকী পবিত্র হজ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার পর প্রথমেই মন্ত্রীসভা থেকে তাকে বাদ দেয় সরকার। এরপর আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম থেকে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। পরে তার প্রাথমিক সদস্য পদও বাতিল করে দলটি। সবশেষ তার এমপি পদ বাতিলে স্পিকার ও নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেয়া হয় দলের পক্ষ থেকে। ১৩ জুলাই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদকে চিঠি দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপি। এতে লতিফ সিদ্দিকীর এমপি পদ থাকা না থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত চাওয়া হয়। সে মোতাবেক বিরোধটি নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া হাতে নেয় ইসি। এরপর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দু’পক্ষকে নিয়ে ২৩ আগস্ট শুনানির আয়োজন করে ইসি। পূর্ব নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত শুনানিতে আইনজীবীদের নিয়ে অংশ নেন লতিফ সিদ্দিকী। আওয়ামী লীগের পক্ষে দলটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম শুনানিতে অংশ না নিলেও তার পক্ষে অংশ নেন তার আইনজীবীরা। শুনানির শুরুতেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য দিতে তার প্রতিনিধিদের বললে আগে বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য সময় চেয়ে নেন লতিফ। অনুমতি নিয়ে কমিশনকে তিনি বলেন, আমি এখান থেকে বের হয়ে গিয়েই পদত্যাগ করব। এ নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। শুনানিরও প্রয়োজন নেই। তার বক্তব্য শুনে কমিশন দুই সপ্তাহ পর শুনানির রায় দেয়ার ঘোষণা দেন। সবশেষে তিনি মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন।